বৈশাখী মেলা

অনলাইন ডেস্ক :

বাংলা নববর্ষ বাঙালির জাতীয় জীবনের আবহমান সংস্কৃতির অংশ। আমাদের সংস্কৃতিতে প্রতিবছর পহেলা বৈশাখ নিয়ে আসে নতুনের বার্তা, যা নব নবরূপে একাত্ম হয়ে বিশেষ কৃষ্টির মহিমায় রূপায়িত হয়। জাতিধর্মনির্বিশেষে এ দিনটি বিশেষ আড়ম্বরের সঙ্গে উদযাপিত হয়ে থাকে। বাঙালি জাতি নিজ মেধা, মনন ও চিন্তা দিয়ে উৎসবমুখর পরিবেশে পালন করে নববর্ষের নানা অনুষ্ঠান।

বৈশাখ বঙ্গাব্দের প্রথম মাস। জানা যায়, বিশাখা নামের নক্ষত্র থেকে বৈশাখের নামকরণ করা হয়েছে। মোগল সম্রাট আকবর বাংলা সন প্রবর্তন করেন। মোগল আমলে বাংলার সামাজিক সংস্কৃতির অভূতপূর্ব উন্নতি হয়। সেসময়ে বাংলা সর্বভারতীয় সংস্কৃতির একই সূত্রে গ্রথিত হয়। বাংলা সন বাঙালি জাতির একাত্মতা ও ঐক্যের সূচক হিসাবেও চিহ্নিত।

সম্রাট আকবর ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করে উনত্রিশ বছর শাসনকার্য পরিচালনার পর বর্ষপঞ্জি সংস্কারের কাজে হাত দেন। তিনি বাংলা সন সম্পর্কিত এক নির্দেশনাও জারি করেন ১০ মার্চ ১৫৮৫ খ্রিষ্টাব্দে। তবে তিনি তা কাগজে-কলমে কার্যকর করেছিলেন পেছন থেকে তথা তার সিংহাসনে বসার সাল থেকেই। তিনি বাংলা সনকে বাঙালি জাতীয় চেতনায়ও উদ্বুদ্ধ করেন।

নতুন বছরের সূচনায় পালিত হয় হালখাতা। পহেলা বৈশাখের আগের দিন অর্থাৎ চৈত্রের শেষ দিনে পালিত হয় চৈত্রসংক্রান্তি, বসে বারোয়ারি মেলা। শহরের মেলায় পান্তাভাত ও ইলিশ খাওয়ার রেওয়াজ চালু হয়েছে। তবে গ্রামবাংলায় মানুষ আর্থিক অনটনের কারণে ইলিশের নাগাল না পেয়ে পেঁয়াজ-মরিচ দিয়ে পান্তা খেয়ে নববর্ষের সূচনা করে থাকে।

গ্রামে একসময় ভেষজ রস, নাড়ু, মোয়া, মুড়ালি, খাজা, চিড়া, দই, গুড়, বাতাসা ইত্যাদি খাবার খেয়ে দিনের সূচনা করা হতো। কোথাও কোথাও এখনো আয়োজন হয় নানা ধরনের খেলাধুলার। বাজানো হয় ঢোলকসহ নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্র। এই দিনে আনন্দ করে শিশু-বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ সবাই।

বাংলা নববর্ষে আমাদের গ্রামবাংলার লোকায়ত সংস্কৃতির অংশ বৈশাখী মেলা যুগ যুগ ধরে বিশেষ তাৎপর্য বহন করে চলেছে। তবে অতীতের মতো পল্লির আনাচে-কানাচে বৈশাখী মেলার দেখা মেলে না। আগে গ্রামের মানুষ, নারী-শিশু-কিশোর-বৃদ্ধ সবাই অপেক্ষা করে থাকত বৈশাখী মেলার বিশেষ দিনের জন্য। মেলায় আগমন ঘটত দূরদূরান্তের নানা বর্ণ ও শ্রেণির মানুষের। অনেকেই সারা বছরের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস সংগ্রহ করত মেলা থেকে।

বৈশাখী মেলা এখন শহরে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এ মেলা এখন প্রতিটি শহরে বসছে নগর সংস্কৃতির আলোকে। বাংলার সংস্কৃতির ঐতিহ্য এ মেলা একসময় নির্দিষ্ট দিনে শুধু গ্রামে বসলেও এখন শহরে মেলার পরিধি বিস্তৃত হয়েছে পাকাপোক্তভাবে। শহুরে সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে গিয়েও যদি বাংলার লোকজ ঐতিহ্যের বৈশাখী মেলা টিকে থাকে, তাহলে হয়তো হারিয়ে যাবে না আমাদের এ লোক উৎসব। আমাদের গ্রামবাংলার লোকায়ত শিল্পধারা সময়ের ঘাত-প্রতিঘাতে বিলুপ্ত হতে চলেছে।

সাম্প্রতিক ও আধুনিক শিল্পধারার কাছে যুগে যুগে প্রবহমান সাধারণ মানুষের জীবনধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত শিল্প ও সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। আমাদের হাসি-কান্না, দুঃখ-বেদনা, আচার-বিচার, জীবন-সংগ্রাম ও নানা সামাজিক কাজে আবৃত লোকায়ত শিল্প; যা আমাদের সন্ধান দেয় শিকড়ের, সম্পৃক্ততা খুঁজে পাওয়া যায় নাড়ির সম্পর্কের।

তাই আবহমান বাংলার লোকজ শিল্প গভীর জীবনাবদী। আমাদের প্রতিটি শিল্পের মাধ্যমে খুঁজে পাওয়া যায় মাটি, মানুষ ও দেশের পরিচয়। বাংলাদেশের সাহিত্য, কবিতা, চিত্রশিল্প, ভাস্কর্য, সংগীত, নাচগান, চলচিত্র, স্থাপত্য, লোক ও কারুশিল্প একটি স্বতন্ত্র পরিচয়ের শিল্প; যা আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থারও ইঙ্গিতবাহী।

কবে কোথায় মেলার গোড়াপত্তন হয়েছিল, তা জানা না গেলেও হিমালয়ের কোলঘেঁষে হরিদ্বারে প্রায় দুই হাজার বছর আগে প্রথম মেলা বসেছিল বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। পরবর্তী সময়ে এ মেলার রেওয়াজ ইউরোপ ও ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে। জানা যায়, শিল্পপণ্য নিয়ে মেলার সূত্রপাত ঘটে ১৭৯৭ খ্রিষ্টাব্দে। পরবর্তী সময়ে মেলার বিস্তৃতি ঘটে আমাদের লোকালয়ে, যা আমাদের সর্বজনীন সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত।

বাংলার গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এ মেলা নববর্ষকে যেমন উৎসবমুখর করে তোলে, তেমনই প্রাণের সঞ্চার হয় আমাদের মনে। মেলা উপলক্ষ্যে ব্যস্ত হয়ে ওঠে একশ্রেণির পেশাজীবী মানুষ। তারা রাতদিন কষ্ট করে মেলা ও বৈশাখীর উপকরণ তৈরি করে। আমাদের বৈশাখী মেলায় পাওয়া যায় কারুপণ্য, কৃষিজাত দ্রব্য, লোকশিল্প জাত জিনিস, কুটিরশিল্পসামগ্রী, খেলনা, নারীদের সজ্জাসামগ্রী, চিড়া, মুড়ি, খই, বাতাসা, চিনির সাজসহ নানা কিছু।

বিনোদনের জন্য থাকে নাগরদোলা, লাঠিখেলা, বাঁশিখেলা, পুতুলনাচ, লোকসংগীত, যাত্রা, পালাগানসহ নানা ধরনের লোকজ অনুষ্ঠান, যা কালে কালে আমাদের দিয়ে আসছে অনাবিল আনন্দ। শিশু-কিশোরদের আকর্ষণের জন্য থাকে বায়োস্কোপ। এ মেলা বাঙালি জীবনের এক অনন্য লোকায়ত সংস্কৃতির ধারক।

বৈশাখী মেলা আমাদের দেশের সব জনপদে একসময় সরব থাকলেও এখন যুগের পরিবর্তনে গ্রামে-গঞ্জের অনেক জায়গায় আয়োজন কমে গেছে। তারপরও ময়মনসিংহ, রংপুর, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, কুমিল্লা, মহাস্থানগড়, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, বরিশাল, খুলনা, গোপালগঞ্জ, ধামরাই, ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে মেলার সরব আয়োজন লক্ষ করা যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *